আমাদের জীবনে প্রযুক্তি এখন কেবল একটি যন্ত্র নয়, বরং এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার অ্যালার্ম থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগে ফোনে ইউটিউব দেখা — প্রতিটি মুহূর্তে প্রযুক্তি আমাদের সঙ্গে।
একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তি কেবল শহুরে জীবনের অংশ নয়; এটি এখন গ্রাম, উপশহর, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।

আগে যেখানে চিঠি লিখে খবর পাঠানো হতো, আজ সেখানে এক ক্লিকেই আমরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যোগাযোগ করতে পারি।
এই পরিবর্তনের পেছনে আছে প্রযুক্তির নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রা — যার ফলে পৃথিবী এখন এক “গ্লোবাল ভিলেজ”।
মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসেছে। প্রথমে আগুন জ্বালানো, চাকা তৈরি, তারপর কৃষির আবিষ্কার — এগুলোই ছিল প্রাথমিক প্রযুক্তির রূপ।
কালের বিবর্তনে মানুষ ধাতব যুগে প্রবেশ করে। লোহা, তামা, ব্রোঞ্জ — এই সব আবিষ্কার মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে।
১৮শ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন, যান্ত্রিক বস্ত্রশিল্প, রেলগাড়ি — এসব উদ্ভাবন মানুষকে দ্রুতগতির জীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
এরপর আসে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, বাল্ব, মোটরগাড়ি — এগুলো আজকের আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি।
২০শ শতাব্দীতে যখন কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের আবিষ্কার হয়, তখন থেকেই শুরু হয় ডিজিটাল বিপ্লব।
আজকের দিনে আমরা এমন এক যুগে পৌঁছেছি, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং, রোবোটিক্স, বিগ ডেটা — এসব শব্দ দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
স্মার্টফোন: হাতের মুঠোয় পৃথিবী
একসময় ফোন মানেই ছিল শুধুমাত্র কথা বলার মাধ্যম। কিন্তু আজকের স্মার্টফোন আমাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
এখন একটি ছোট্ট ডিভাইসের মাধ্যমেই আমরা ছবি তুলি, ভিডিও করি, খবর পড়ি, ব্যাংকিং করি, ব্যবসা পরিচালনা করি, এমনকি পড়াশোনাও করি।
স্মার্টফোনের প্রভাব:
- অনলাইন শিক্ষা (e-Learning) আজ সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে।
- টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষও চিকিৎসা পাচ্ছে শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছ থেকে।
- কৃষকরা আবহাওয়ার খবর, বাজারমূল্য ও কৃষি–পরামর্শ পাচ্ছেন মোবাইল অ্যাপে।
- উদ্যোক্তারা ফেসবুক বা ই–কমার্স অ্যাপ দিয়ে ব্যবসা বাড়াচ্ছেন।
বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন প্রায় ১৩ কোটির বেশি।
এটাই প্রমাণ করে, প্রযুক্তি আর বিলাসিতা নয় — এটি এখন জীবনধারার অংশ।
ইন্টারনেট: বিশ্বকে এক করেছে
ইন্টারনেট হলো আধুনিক যুগের অক্সিজেন।
আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে তথ্য পাওয়া মানেই ক্ষমতা।
গুগল, ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়া—এই প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের শেখার, যোগাযোগের, বিনোদনের ও আয়ের মাধ্যম।
ইন্টারনেট আমাদের জীবনে যেভাবে পরিবর্তন এনেছে:
শিক্ষা: এখন ইউটিউব, কোরসেরা বা বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির অনলাইন কোর্সে সহজেই শেখা যায়।
চাকরি ও ব্যবসা: ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, অ্যাফিলিয়েট আর্নিং—সবই ইন্টারনেট নির্ভর।
যোগাযোগ: ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ভিডিও কল—সবকিছু মুহূর্তেই।
বিনোদন: নেটফ্লিক্স, স্পটিফাই, ইউটিউব—সবই আমাদের ঘরে বসে পাওয়া যায়।
সামাজিক প্রভাব: মানুষ এখন মতামত প্রকাশে আরও স্বাধীন। তবে ভুয়া তথ্য বা সাইবার অপরাধও বেড়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): মানুষের সঙ্গী, নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী?
AI এখন প্রযুক্তির সবচেয়ে আলোচিত শব্দ।
সাধারণভাবে, AI হলো এমন এক প্রযুক্তি যা মেশিনকে “ভাবতে শেখায়” — অর্থাৎ, মানুষের মতো বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে।
AI আমাদের জীবনে যেভাবে কাজ করছে:
ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট: Google Assistant, Siri, Alexa — আমাদের দৈনন্দিন সহকারী।
স্বাস্থ্যসেবা: AI এখন রোগ নির্ণয়, ডায়াগনস্টিক ইমেজ বিশ্লেষণ, এমনকি ওষুধ তৈরি পর্যন্ত সাহায্য করছে।
পরিবহন: স্বয়ংক্রিয় (Self-driving) গাড়ি ভবিষ্যতের বাস্তবতা।
শিক্ষা: AI–চালিত লার্নিং অ্যাপ শিক্ষার্থীর মান অনুযায়ী পাঠ্য সাজায়।
কন্টেন্ট তৈরি: আজ অনেক ব্লগ, ভিডিও বা ডিজাইন AI–এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে।
তবে AI–এর সঙ্গে উদ্বেগও রয়েছে। অনেকেই ভাবছেন, এটি কি মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন — AI চাকরি কেড়ে নেবে না, বরং যারা AI ব্যবহার জানে না, তারাই পিছিয়ে পড়বে।
অর্থাৎ, প্রযুক্তি আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি হতে পারে আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সহযোগী।
বাংলাদেশের প্রযুক্তি বিপ্লব
বাংলাদেশ এখন প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক দূর এগিয়েছে।
“ডিজিটাল বাংলাদেশ” রূপকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে অনলাইন শিক্ষা, ই–কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং, এবং স্টার্টআপ কালচার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশের কিছু বড় প্রযুক্তিগত অর্জন:
- ই–গভর্নেন্স: নাগরিক সেবা, পাসপোর্ট আবেদন, জন্মনিবন্ধন — সব অনলাইনে।
- মোবাইল ব্যাংকিং: বিকাশ, নগদ, রকেট — এখন গ্রামে বসেই টাকা লেনদেন সম্ভব।
- ই–কমার্স: দারাজ, চালডাল, আজকেরডিল — অনলাইন শপিংয়ের নতুন যুগ।
- ফ্রিল্যান্সিং: বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ফ্রিল্যান্সার দেশ।
- স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম: Pathao, ShopUp, 10 Minute School — দেশীয় উদ্ভাবনের সফল উদাহরণ।
ভবিষ্যতের প্রযুক্তি: কল্পনা নয়, বাস্তবতা
প্রযুক্তির গতি এত দ্রুত যে, আজ যা “ফিউচার টেকনোলজি” মনে হচ্ছে, আগামীকাল সেটিই হয়ে যাবে সাধারণ ব্যাপার।
ভবিষ্যতের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক:
- মেটাভার্স: ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও অগমেন্টেড রিয়েলিটির সমন্বয়, যেখানে মানুষ ডিজিটাল জগতে “বাস” করতে পারবে।
- কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: ডেটা প্রক্রিয়াকরণের গতি হাজারগুণ বাড়াবে।
- সবুজ প্রযুক্তি: পরিবেশ রক্ষায় টেকসই (sustainable) উদ্ভাবন যেমন সোলার পাওয়ার, ইলেকট্রিক কার।
- জীবপ্রযুক্তি (Biotech): মানুষের জিন সম্পাদনা (Gene editing) থেকে শুরু করে কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন—সবই এখন গবেষণার পর্যায়ে।
- AI ইন্টিগ্রেটেড সমাজ: ভবিষ্যতে গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে চিকিৎসা, শিক্ষা, এমনকি আইন পর্যন্ত—সব ক্ষেত্রেই AI কাজ করবে।

প্রযুক্তির সুবিধা ও অসুবিধা
প্রযুক্তির আশীর্বাদ যেমন অসীম, তেমনি এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে।
সুবিধা:
- কাজের গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধি
- তথ্যপ্রাপ্তি সহজ
- যোগাযোগে বিপ্লব
- শিক্ষা ও চিকিৎসা সহজলভ্য
- কর্মসংস্থান ও নতুন পেশার সুযোগ
অসুবিধা:
- মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি
- ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা হারানো
- সাইবার অপরাধ ও ভুয়া তথ্য ছড়ানো
- প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় মানসিক চাপ
তাই প্রযুক্তির সঠিক ও সচেতন ব্যবহারই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
প্রযুক্তি আজ কেবল একটা বিষয় নয় — এটি এখন মানব সভ্যতার রক্তধারা।
সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি পারে দারিদ্র্য হ্রাস করতে, শিক্ষা পৌঁছে দিতে, চিকিৎসা সহজ করতে, এমনকি পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে তুলতে।
তবে ভুল ব্যবহার করলে এর ফল উল্টো হতে পারে — যেমন ভুয়া তথ্য, আসক্তি, ও সাইবার ঝুঁকি।
তাই প্রয়োজন প্রযুক্তি–সচেতনতা, নৈতিকতা এবং মানবিক ব্যবহার।
কারণ, প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে না — আমরা প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করব।
